তুরস্কের প্রধান বিরোধী জোট "ন্যাশন অ্যালায়েন্স" রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জের জন্য ইস্তানবুলের জনপ্রিয় মেয়র একরেম ইমামোগলুকে তাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে। ২০২৩ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে বিরোধী দলগুলোর এই সিদ্ধান্ত তুরস্কের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এরদোয়ানের ২০ বছরের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে বিরোধীপক্ষের একত্রিত হওয়া এবং ইমামোগলুর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগানোর কৌশলই এই ঘোষণার পেছনে মূল কারণ বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
ইমামোগলুর উত্থান ও রাজনৈতিক পটভূমি
৫২ বছর বয়সী একরেম ইমামোগলু তুরস্কের মূল বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপল’স পার্টির (সিএইচপি) নেতৃত্বাধীন জোটের মুখ্য মুখ হয়ে উঠেছেন। ২০১৯ সালে ইস্তানবুলের মেয়র নির্বাচনে এরদোয়ানের দল একেএইচ-এর প্রার্থীকে হারিয়ে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনায় আসেন। তার নম্র কিন্তু দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের দক্ষতা এবং দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে সরব ভূমিকা তাকে তুরস্কের শহুরে ও যুবসমাজের মধ্যে আইকনে পরিণত করেছে। বিশেষ করে মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে তার সমালোচনা এরদোয়ান সরকারের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জোটের ঐক্য ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত
ন্যাশন অ্যালায়েন্সে সিএইচপি ছাড়াও গুড পার্টি (ইয়ি পার্টি), ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং ফিউচার পার্টির মতো ছয়টি দল জোটবদ্ধ হয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে জোটের মধ্যে প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা চললেও ইমামোগলুর জনসমর্থন এবং ২০১৯ সালের নির্বাচনে তার সাফল্য শেষ পর্যন্ত তাকে প্রার্থী হওয়ার পথ প্রশস্ত করে। জোটের নেতারা মনে করছেন, এরদোয়ানের স্বৈরাচারী শাসন ও অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে ইমামোগলুর "সাধারণ মানুষের মুখপাত্র" ইমেজ কাজে লাগানো যাবে।
এরদোয়ানের জন্য চ্যালেঞ্জ
ইমামোগলুর প্রার্থীতাকে এরদোয়ান সরকার গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। গত দুই দশকে ক্ষমতায় থাকা এরদোয়ান মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ, বিচারব্যবস্থায় প্রভাব এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর তার কর্তৃত্বকে কাজে লাগিয়ে বিরোধীদলকে দুর্বল করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কের লিরার অবমূল্যায়ন, মুদ্রাস্ফীতির হার ৮০% ছাড়ানো এবং তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২০% এর কাছাকাছি পৌঁছানো এরদোয়ানের জনপ্রিয়তায় চিড় ধরিয়েছে। ইমামোগলু এই সংকটগুলোকে তার প্রচারের মূল বিষয় হিসেবে তুলে ধরার পরিকল্পনা করেছেন।
বাধা ও সম্ভাব্য সংঘাত
যদিও ইমামোগলুর জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্য, তাকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। প্রথমত, এরদোয়ানের সমর্থকরা—বিশেষ করে রক্ষণশীল গ্রামীণ এলাকা এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী—ইমামোগলুর ধর্মনিরপেক্ষ ও পশ্চিমাপন্থী অবস্থানকে সন্দেহের চোখে দেখেন। দ্বিতীয়ত, সরকারপক্ষ ইতিমধ্যে ইমামোগলুর বিরুদ্ধে "রাজনৈতিক মামলা" দায়ের করার হুমকি দিয়েছে, যা তার প্রচারাভিযানকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তৃতীয়ত, বিরোধী জোটের ভেতরেও নীতিগত বিভক্তি রয়ে গেছে, যা ঐক্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইমামোগলুর প্রার্থীতাকে পশ্চিমা দেশগুলো ইতিবাচকভাবে দেখছে। তুরস্কের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উত্তেজনা, ন্যাটোতে অনিশ্চয়তা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এরদোয়ানের ভূমিকা নিয়ে পশ্চিমা নীতিনির্ধারকরা অস্বস্তিতে রয়েছেন। ইমামোগলু যদি জয়ী হন, তাহলে তুরস্কের বৈদেশিক নীতি পুনরায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও পশ্চিমা জোটের দিকে ঝুঁকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নির্বাচনের মুখোমুখি তুরস্ক
২০২৩ সালের নির্বাচন তুরস্কের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হতে চলেছে। এরদোয়ানের পক্ষে এটি হবে ক্ষমতায় থাকার লড়াই, আর বিরোধী জোটের জন্য এটি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সুযোগ। ইমামোগলু যদি তার চারিত্রিক দক্ষতা ও জোটের ঐক্য বজায় রাখতে পারেন, তবে তুরস্কের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে। তবে, এরদোয়ানের রণকৌশল ও প্রতিষ্ঠানিক কর্তৃত্ব এখনও শক্তিশালী, যা এই লড়াইকে অনিশ্চিত করে রেখেছে।
শেষ কথা:
একরেম ইমামোগলুর প্রেসিডেন্ট প্রার্থীতার মধ্য দিয়ে তুরস্কের রাজনীতি জটিল এক পর্বে প্রবেশ করেছে। এই নির্বাচন কেবল একজন নেতার লড়াই নয়, বরং তুরস্কের ভবিষ্যৎ পরিচালনার ধারা—স্বৈরতন্ত্র বনাম বহুদলীয় গণতন্ত্র—তারই প্রতিফলন ঘটাবে। বিশ্বের নজর এখন এই নির্বাচনের দিকে, যা মধ্য প্রাচ্য ও ইউরোপের ভূরাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।